এখান থেকেই বোঝা যায় সুহান রিজওয়ানের 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, যেখানে এই ঢাকার অন্য এক রূপ উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আসলে তেজস্ক্রিয় মহাবিস্ফোরণের পরের যে ঢাকা বা বাংলাদেশের গল্প বলা হয় তা আসলে আজকের এই ঢাকারই গল্প। সুহান রিজওয়ান মূলত এই সময়টাকে, সময়ের ঘটনার সাথে নানা উপসর্গ, অনুসর্গ ও অনুষঙ্গ যোগ করে এক নতুন ঢাকাকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ডিস্টোপিয়ার সেই পুরনো আবছা, কালো অবয়ব এখানে নেই। সুহান যে ঢাকাকে দেখান তা স্পষ্ট। ইকবাল, আইয়ুবীর কালা কানুন আমাদের মনে করিয়ে দেবে ঊনসত্তর থেকে নব্বই। জনতার মঞ্চ কী মনে করাবে তা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবে। তাহলে সুহান রিজওয়ানের লেখার বিশেষত্ব কী?
এ উপন্যাসের গঠন ও আঙ্গিকের দিকে যাই তাহলে দেখব একটি অধ্যায় এই উপন্যাসের সময়ের গল্প বলে। পরবর্তী অধ্যায়েই আসে নানা বিচার বিশ্লেষন, ব্যাখ্যা। অর্থাৎ ফিকশন এবং নন ফিকশনের মধ্য দিয়ে কাহিনী এবং এর আনুশাঙ্গিক বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন। এই ২০১০/১১ থেকে শুরু হয়ে ২০২১/২২ এর যে সামাজিক, রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা গেছি সে বিষয়গুলোই ভবিষ্যতের আবরণে তুলে আনা হয়েছে। মূল যে বিষয়টি ধরে লেখক এগিয়েছেন তা হলো সিরিজে আকা কিছু গ্রাফিতি। 'ঋজুশির' নামে অজ্ঞাত কোনো শিল্পির আঁকা গ্রাফিতি কেমন করে একটা সময়কে ধারণ করে, কিংবা কোনো গ্রাফিতি নয় বরং একটা সময়ে স্রোতে না ভেসে থেমে থেকে, নিভৃতে কাজ করে যাওয়া চিন্তাশীল, সংবেদনশীল মানুষেরা কী করে দেশ, সময় ও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, সুহান রিজওয়ান সে গল্প বলতে চেয়েছেন। গল্পটা বলতে গিয়ে তিনি অগুনতি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তর দিয়েছেন, কখনও ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের হাতে।
গ্রাফিতি থেকে শুরু করে বেতাল পঞ্চবিংশতিকে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে এ বইয়ের লেখক আমাদেরকে লেখার এক নতুন ধরনের হদিস দিয়েছেন। এখানে কোনো উপদেশ নেই, আছে আত্মবিশ্লেষণ। কিংবা সেখান থেকে সময়কে, মানুষকে, ক্ষমতাকে বা প্রবৃত্তিকে বিশ্লেষণ। আদতে এই বই পড়তে গিয়ে সবকিছুকেই অনুভব করা যাবে। অসহায়তা অনুভূত হতে হতেও হবে না তবে বুঝতে পারা যাবে আমাদের আসলে কিছুই করার নেই। সেই না থাকা নিয়ে শেষটায় এসে পাঠকের আক্ষেপ হতে পারে কেন লেখক কোনো পথনির্দেশ করলেন না। কিন্তু এই আক্ষেপ আসলে বৃথা। কেননা গ্রাফিতি প্রশ্ন করে যায়, উত্তর খুঁজতে হয় মানুষকে।
এ বইয়ে সুহান রিজওয়ান বারবার একটা প্রশ্ন করেছেন, কেন লিখতে হবে? পাশাপাশি, এ বইয়ে (এবং দেশ বিদেশের অন্যান্য বহু লেখায়) বারবার বলা হয়েছে প্রতিটি লেখা, প্রতিটি শিল্প এক একটা আবিষ্কার। হতে পারে সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি সচেতনতা থাকবে, হতে পারে থাকবে না। কিন্তু লিখতে হয় (বা শিল্প চর্চা করতে হয়) কোনো কিছু আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে, বিশেষত নিজের মধ্যে। গ্রাফিতির করা প্রশ্নের উত্তর পাঠক খুঁজবেন। নিয়ন বাতি, টিএসসির কনসার্ট বা সরোবরের আড্ডা বা সড়ক আন্দোলন মিলিয়ে ঢাকার যে রঙ, সে ঢাকার ভিন্ন রঙের আবিষ্কার করতে করতে সুহান রিয়াসাত আমাদের সেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা বা লেখার উদ্দেশ্য দেখিয়ে দেন।
গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে
সুহান রিজওয়ান
দেয়াল উঠছে বিচ্ছিন্নতার, স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের, তেজস্ক্রিয়তায় উবে যাচ্ছে সমস্ত কিছু। দুনিয়া-বিচ্ছিন্ন ওই জনপদে তবু কেন আইন অমান্য করে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে যাচ্ছে কেউ?