নতুন মলাটের বাঙালিয়ানা

ধ্রুপদি সাহিত্য আর আমার বই পড়া

পাঁচ বছর বয়সে এক শীতের সকালে রূপকথার বই উপহার পাওয়া দিয়ে আমার পাঠক জীবন শুরু। পরের ২০টা বছর পড়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে নানা দেশের, নানা ভাষার আর নানা ধারার সহস্রাধিক বই। প্রেম, রাজনীতি, বিরহ কিংবা লোককথা থেকে চিরায়িত সাহিত্য কিছুই বাদ পড়েনি পড়ার তালিকা থেকে। কখনো ভুল কারণে কোনো বই পড়ার চেষ্টা করেছি তো কখনো ঠিক কারণে ফিরে এসেছি পুরনো বইয়ের কাছেই। আমার বই পড়ার শুরুর দিনগুলোতে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা ছিল না আমাদের। কী বই পড়ব তা বলার জন্য ফেসবুকের বড় বড় পণ্ডিত কিংবা গুগলের সাজেশন ছিল না। মা-বাবার আলমারি ভর্তি বই, উৎসব-আনন্দে সবার দেওয়া উপহার আর সপ্তাহান্তে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরিই ছিল ভরসা। বইয়ের দোকানে কোনো বইয়ের মলাটে চোখ আটকানো কিংবা ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের কথায় মিলত বইয়ের খোঁজ। নিজের অজান্তেই কখন চিরায়িত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় বলতে পারব না।

'একটু সুন্দর মলাটের বইয়ের লোভ তো সেই ছোটবেলা থেকেই। ক্লাসিক সাহিত্যের বাংলা বইগুলো পড়তে গিয়ে সুন্দর মলাট না পাবার যে দুঃখ ছিল তা ঘুচিয়ে দিয়েছে বাতিঘর।'

সূচনা হাসনাত, বুক রিভিউয়ার, 'সূচনা অলওয়েজ'

ধ্রুপদি অর্ডার করুন

তবে নতুন করে ক্লাসিক সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার বড়বেলায়—ফেসবুক, ইউটিউব আর ব্লগপোস্টের সুবাদে। দুটো ঘটনা খুব করে আমার মনোযোগ কাড়ে। প্রথমটা হলো মহা-পণ্ডিত অ-পাঠকদের লেখা সমালোচনামূলক সব ফেসবুক পোস্ট, যাতে তারা জাহির করেন যে তারা কতটা জাতের পাঠক আর অন্যরা কতটা অজাতের। অবলীলায় লিখেই দেন তারা, সমসাময়িক লেখকদের লেখা সস্তা আর উঁচুদরের পাঠক হতে হলে ক্লাসিক সাহিত্য পড়তেই হবে। দ্বিতীয়টা হলো নানান ব্লগে ছাপানো এ শতাব্দীর সেরা ১০০ বইয়ের তালিকা । হিসাব করে সেই তালিকায় যখন নিজের পড়া ১২ কি ১৫টা বই বের করতে পারি, তখন ভেবেই নিই আমি বুঝি আসলেই খুব জাতের পাঠক হতে পারিনি!

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ভালো পাঠক হতে হবে তো! তাই ছয় কি সাত বছর আগে আমি বিশ্ব আর বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক বইগুলো পড়ার পণ করে বসি। এসময় গোরা, The Great Gatsby পড়ে যেমন অভিভূত হই, একই ভাবে ‘সেরা বই’ পড়েছি বলতে পারার লোভে শ্রীকান্ত, Alice in Wonderland-এর মতো বই তাড়হুড়োয় পড়তে গিয়ে পড়ার আনন্দটাও মাটি করে ফেলি।

বলাই বাহুল্য, এ সময়ে যে দুটো কারণে ক্লাসিক সাহিত্য পড়ার ইচ্ছে হয়েছিল, তার কোনোটাই বই পড়ার প্রকৃত কারণ ছিল না। সময়ের সঙ্গে এসব সুপারফিশিয়াল বিষয়ে আগ্রহ কমেছে, আগ্রহ বেড়েছে জানার প্রতি। এখন আমি যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ পড়ার জন্য হাতে নিই, নিজের ভেতর এই কৌতূহল থেকে নিই যে আসলে লেখক এতকাল আগে, এমন জটিল সম্পর্কগুলোকে কীভাবে লিখেছিলেন। যখন বইটা পড়া শেষ করি, চরিত্রদের ওপর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বসে থাকলেও লেখা আর গল্পের ব্যাপ্তি দেখে মুগ্ধ হই। কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতা পড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যে ধারণা জন্মেছিল, তা নিয়ে ‘দত্তা’ পড়া শুরু করে শুধু অবাক হই! চিন্তার পরিবর্তন আসে নিমেষেই। সেসময়ের যে ছবি লেখক এঁকেছেন, বিজয়ার যে সংঘাত দেখিয়েছেন তা দেখে সেই সময়কে নতুন করে জানি। যত পড়ি তত দেখি কীভাবে এই লেখাগুলো দিনের পর দিন আমাদের সাহিত্য, সংগীত,সিনেমা, পোশাক সবকিছুতে ছাপ ফেলে চলেছে। কীভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার ছাপ রয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের মাঝে। কীভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা ভাষার মাধূর্য এখনো সবার কথায়, ছবিতে, গল্পে বিচরণ করছে।

'SUCHONABG24' কোড ব্যবহারে থাকছে অতিরিক্ত ৫% ছাড়। বাতিঘর ধ্রপদি সিরিজ অর্ডার করতে ক্লিক করুন 'Order Now' বাটনে

এখনো এই বইগুলো প্রতিনিয়ত নিজেকে, বাংলাকে, প্রেমকে নতুনরূপে পথ দেখিয়ে চলেছে জানায়। শরৎকাল এলে ফেসবুকে ঢুকে দেখি অনেকে দুর্গা আর অপু সেজে ছবি তুলেছে। এখন আমি বুঝি এই বইগুলো ছাড়া আমার বাঙালিয়ানা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এসব বই পড়েই সমসাময়িক লেখক ও লেখার প্রতি ভালোবাসা বাড়ে, বুঝি সাহিত্য কেমন করে বিশেষ বিশেষ সময়কে তুলে ধরে।  

আমি সমসাময়িক লেখাগুলো পড়তে পড়তে তাই ফিরে আসি চিরায়িত সাহিত্যে। শীতের সকালে কুয়াশা কেটে গুড়ের চায়ে রুটি ভিজিয়ে খেতে খেতে পাতা ওলটাই নতুন কেনা বাংলা ক্লাসিকের। বইয়ের দোকানে হাতভর্তি বই নিয়ে হেমন্তের বিকালে পড়বার জন্য বইয়ের রসদ জমাই।

কেউ কেউ আজকাল জানতে চায়, কোন বই না পড়লেই নয়। আমি বলি, কোনো বই না পড়লেও ক্ষতি নেই। কিন্তু কেন পড়ছি এটা খুব জরুরি। আজকের দিনের বাংলা সাহিত্য কীভাবে এখানে এল, প্রেমের রূপ কীভাবে পরিবর্তন হলো, রবীন্দ্রনাথ থেকে মানিক, বুদ্ধদেব বসু থেকে হুমায়ূন আহমেদ একই বিবাহবহির্ভূত প্রেমকে কত রূপে, কত রঙে দেখল এবং দেখাল তা নিয়ে জানার যার আগ্রহ কিংবা কাশফুলের মাঠ থেকে বহুতল ভবনে গল্পগুলো কীভাবে জায়গা পেল তা নিয়ে যার আগ্রহ, ক্লাসিক সাহিত্য তো তারই জন্য। তাই জানতে চাইলে পড়বে, না পড়লেও ক্ষতি নেই। তবে পড়তে যে সত্যি ভালোবাসে, দেশ বিদেশের লেখা পড়তে থাকলে কখনো না কখনো নিজে থেকেই চিরায়িত সাহিত্যের কাছে এসে তাকে দাঁড়াতে হয়ই।

আমার চিরায়িত সাহিত্যের থলেতে ২০১৯ সাল থেকে যোগ হয়েছে বাতিঘরের ধ্রুপদি সিরিজের বইগুলো। একটু সুন্দর মলাটের বইয়ের লোভ তো সেই ছোটবেলা থেকেই। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক বইগুলো পড়তে গিয়ে সুন্দর মলাট না পাওয়ার যে দুঃখ ছিল তা ঘুচিয়ে দিয়েছে বাতিঘর। একটু লজ্জা লাগে বলতে কিন্তু এই পাঁচ বছরে এমন হয়েছে যে এখন ওদের ক্লাসিক বই ছাড়া আর পড়তে মনই টানে না। হলুদাভ কাগজে ছাপা, হার্ডকভার বাঁধাইয়ের এই বইগুলো আমার ছোট হাতেও কেমন মিশে যায়। ধ্রুপদি সিরিজের নতুন বই বাতিঘর কখন আনবে আমি তারই অপেক্ষায় থাকি। মাঝে সাঝে আবদার করে বসি, অমুক বই আগে আনুন। এই করতে করতে ১৭টা বই বেরোল ওদের। আমি সেসব কিনি, বইয়ের তাকে তুলে রাখি, ঝিঁঝি ডাকা সন্ধ্যায় সেই বই খুলে বসে হারিয়ে যাই সেই কতদিনের পুরনো গল্পে।

 

'আপনাকে বলছি স্যার : বারবারিয়ানা স্কুল থেকে' বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া